বন্দনা-শাহ মুহম্মদ সগীর (ব্যাখ্যা)
এখানে কবি মুহম্মদ সগীর তাঁর কাব্য রচনার শুরুতে তাঁর গুরুজন এবং সমাজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। প্রতিটি চরণের আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।
প্রথম স্তবক: পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা
দ্বিতীয়ে প্রণাম করোঁ মাও বাপ পাত্র।
যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায় ॥
ব্যাখ্যা: কবি প্রথমে তাঁর বাবা ও মাকে প্রণাম করছেন। তিনি বলছেন, এই পৃথিবীতে তাঁর জন্ম হয়েছে কেবল তাদের দয়ার কারণেই।
পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত।
কোল দিআ বুক দিআ জগতে বিদিত ॥
ব্যাখ্যা: তিনি মায়ের পরম স্নেহের কথা স্মরণ করছেন। মা পিঁপড়ের ভয়ে তাঁকে মাটিতে নামিয়ে রাখতেন না। বুকে ও কোলে করে সবসময় আগলে রাখতেন। এই গভীর ভালোবাসা জগতের সবার কাছে পরিচিত।
অশক্য আছিলু মুই দুর্বল ছাবাল।
তান দয়া হন্তে হৈল এ ধড় বিশাল।
ব্যাখ্যা: কবি বলছেন, তিনি যখন দুর্বল ও অসহায় শিশু ছিলেন, তখন বাবা-মায়ের যত্নেই তাঁর এই বিশাল শরীর গঠিত হয়েছে।
না খাই খাওয়াএ পিতা না পরি পরাএ।
কত দুক্ষে একে একে বছর গোঞাএ।
ব্যাখ্যা: বাবা-মা নিজেদের কষ্ট করে তাঁকে বড় করেছেন। নিজেরা না খেয়ে তাঁকে খাইয়েছেন এবং নিজেদের জন্য জামা-কাপড় না কিনে তাঁকে পরিয়েছেন। এভাবেই অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে তাঁরা বছর পার করেছেন।
পিতাক নেহায় জিউ জীবন যৌবন।
কনে বা সুধিব তান ধারক কাহন ॥
ব্যাখ্যা: বাবা-মা তাঁদের পুরো জীবন ও যৌবন তাঁর জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। কবি বলছেন, তিনি কীভাবে এই বিশাল ঋণ শোধ করবেন? এই ঋণ কোনোভাবেই শোধ করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় স্তবক: শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা
ওস্তাদে প্রণাম করোঁ পিতা হন্তে বাড়।
দোসর-জনম দিলা তিহ সে আহ্মার॥
ব্যাখ্যা: কবি তাঁর শিক্ষককে বাবার থেকেও বেশি সম্মান দিচ্ছেন। কারণ, শিক্ষক তাঁকে জ্ঞান দিয়ে নতুন বা দ্বিতীয় জন্ম দিয়েছেন। এই জন্ম শারীরিক নয়, বরং জ্ঞান ও মননের।
তৃতীয় স্তবক: পৌরজন ও বন্ধুদের প্রতি শ্রদ্ধা
আহ্মা পুরবাসী আছ জথ পৌরজন।
ইষ্ট মিত্র আদি জথ সভাসদগণ।
ব্যাখ্যা: কবি তাঁর শহরের সব মানুষ, বন্ধু-বান্ধব এবং সভায় উপস্থিত সকল সদস্যকে সম্বোধন করছেন।
তান সভান পদে মোহার বহুল ভকতি।
সপুটে প্রণাম মোহার মনোরথ গতি ॥
ব্যাখ্যা: তিনি বলছেন, তাঁর হৃদয়ে তাদের প্রতি গভীর ভক্তি আছে। তাঁর মনের ইচ্ছা হল, তিনি নত মস্তকে সবাইকে প্রণাম জানাচ্ছেন।
চতুর্থ স্তবক: বিনয় ও ক্ষমা প্রার্থনা
মুহম্মদ সগীর হীন বহোঁ পাপ ভার।
সভানক পদে দোয়া মাগোঁ বার বার।
ব্যাখ্যা: শেষ চরণে কবি মুহম্মদ সগীর নিজেকে পাপী এবং দীন বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলছেন, তিনি অনেক পাপের ভার বহন করছেন এবং এই কাব্য রচনার জন্য সবার কাছে বারবার দোয়া বা আশীর্বাদ চেয়েছেন। এটি কবির বিনয় প্রকাশ করে।
Comments
Post a Comment